মৃত ব্যাক্তিদের রাজত্ব এখান থেকেই শুরু

৬০ লাখ মৃত মানুষের ফিসফিস আওয়াজ শোনা যায় যেখানে 

মৃত ব্যাক্তিদের রাজত্ব এখান থেকেই শুরু
কি আছে প্যারিসের ক্যাটাকম্বসে? 


'থামো! এটা মৃতদের রাজ্য।' এটি প্রবেশদ্বারে সতর্কতা হিসেবে লেখা আছে । মাটির অনেক গভীরে, অর্থাৎ 20 মিটার, মানে 66 ফুট নিচে একটি বিশাল সমাধিস্থল । একটি ভুতুড়ে পাতাল, হিমশীতল নীরবতা যেন আলো-আঁধারে কাঁপছে। 

তবে এই নিস্তব্ধ, নিথর বিশাল কবরস্থানে রয়েছে হাজারো মানুষের কোলাহল রাত হলেই শুনতে পাওয়া যায় হাজার বছর পূর্বে মারা যাওয়া মানুষের আর্তনাদ। কিন্তু এই কবরের উপরে বিভিন্ন জাতি-বর্ণ-ধর্মের ব্যস্ত মানুষ যারা জীবন-জীবিকার সন্ধানে ছুটছে। ঝকঝকে আলোয় জমজমাট শপিংমল।

 জনাকীর্ণ রাস্তায় বাস, ট্রাম, ট্রেন, গাড়ির সারি,পারফিউমের রোমান্টিক শহরে, প্যারিস গর্ব, ভালবাসা এবং সুখে পূর্ণ একটি প্রাণবন্ত পৃথিবী৷ ফরাসি সংক্ষেপে 'প্যারি'। কেউ কেউ কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে এই শহরকে পৃথিবীর 'নাভি' বলে ডাকে। 

কি নেই এই বিশাল শহরে? সব আছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, ঘটনাবহুল ইতিহাস, বাহারি ফ্যাশনের নজরকাড়া গয়না, শিল্প-সাহিত্যের বাড়তি চাকচিক্য, নান্দনিকতা।এত কিছু থাকা সত্বেও এই মায়াময় শহরে রাত্রির কালো আধার নামে । 


মাটির ৬৬ ফুট গভীরতা থেকে উঠে আসে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের ফিসফিস শব্দ। এটি সেই শব্দ যা মহামারী এবং শীতের সময় প্যারিসের আকাশকে বিভক্ত করে। আমরা যেন মাটির 66 ফুট নিচ থেকে ভবিষ্যৎ মৃতদের পূর্বপুরুষদের কথা শুনতে পাচ্ছি! আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ফ্রান্সের প্রথম রাজা ক্লোভিস প্যারিসে তার রাজধানী স্থাপন করেন। সেই থেকে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই শহরটি ফ্রান্সের রাজধানী। আজও মোনালিসার শহর প্যারিস তার সব গোপন কথা প্রকাশ করেনি। 

এই শহরের মাটির নিচে রয়েছে অন্য এক জগত, অনেক সুড়ঙ্গ। এর দৈর্ঘ্য হবে এক হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। এটা অনেকটা মাটির নিচে বিশাল অন্ধকূপের মতো। বিভিন্ন স্থাপনা, বিশাল গ্যালারি। আন্ডারওয়ার্ল্ডে আর কোনো শহর আছে বলে মনে হয় না। মাটির নিচের এই অন্ধকার জগত নিয়ে রয়েছে কতশত গল্প। ভিক্টর হুগোর 'লা মিজারেবল' উপন্যাসের প্রধান চরিত্র "জঁ ভালজঁ " চোখ এড়াতে সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গগুলো বেছে নিয়েছিলেন। সেই গল্প অনেকেই জানেন।

প্যারিসের ক্যাটাকম্বস,
cities of the underworld catacombs 


 নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও অন্ধকার জগতের কিছু মানুষ নির্দ্বিধায় বিচরণ করে এই পাতালে। অনেক লোক এই শহরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যায় এবং গাড়িতে চড়ে বেড়ায় । আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন যে আপনার পায়ের নীচে অন্য একটি পৃথিবী রয়েছে, আরেকটি বিশাল ভূগর্ভস্থ শহর। সবচেয়ে বড় চমক হল এই শহরের মাটির 66 ফুট নীচে একটি বিশাল সমাধিক্ষেত্র, লক্ষ লক্ষ কঙ্কালের নীরব শহর। এখানে রয়েছে 6 মিলিয়ন মানুষের কঙ্কাল, 6 মিলিয়ন মানুষের মাথার খুলি, হাড়, যা এই শহরের জীবিত মানুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি - ওজন 100,000 টনেরও বেশি! 

কোকিল শুধু বসন্ত কালে ডাকে কেন?

18 শতকে ভূগর্ভস্থ কবরস্থান ভেঙে ফেলা হয়েছিল। বিশেষ মহামারীর কারণে প্যারিসে স্বাস্থ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ফলস্বরূপ, পৌর কর্তৃপক্ষ শহরের বেশ কয়েকটি কবরস্থান থেকে মানব দেহাবশেষ সরিয়ে শহর থেকে দূরে একটি বিশাল ভূগর্ভস্থ স্থানে জমা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি 1785 থেকে 1787 সালের মধ্যে প্রথমবারের মতো করা হয়েছিল। মানব কঙ্কালের বিশ্বের বৃহত্তম সংগ্রহ প্যারিসের 14টি শহরতলিতে অবস্থিত এবং এর নাম 'ক্যাটাকম্বস'। 


1809 সাল থেকে মৃত শহরের গেটগুলি আংশিকভাবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। 300 কিমি জুড়ে রাশির ভিড় পর্যটকরা কঙ্কালের মধ্য দিয়ে সরু রাস্তায় কেবল দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে, এর বেশি নয়। এই পথে উপরে এবং নিচে 243টি ধাপ বা সিড়ি রয়েছে। গড় তাপমাত্রা 14 ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরমে গরম কাপড় সঙ্গে রাখা ভালো। পর্যটকরা যেটুকু দেখতে পান তা 1 শতাংশের মাত্র অর্ধেক। অন্য কথায়, তাদের মধ্যে 99 শতাংশেরও বেশি অদৃশ্য থেকে যায়।

 এখানে বিশাল সংখ্যক কঙ্কাল দিয়ে সাজানো হয়েছে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে মহান দক্ষতা এবং যত্নসহকারে। এমনকি মৃত মানুষের কঙ্কালও এমন আলংকারিক উপাদান হিসেবে সবাই বিবেচনা করে । মানব কংকাল যে সংগ্রহ করে রাখার মত বস্তু হতে পারে তা অনেকটাই কল্পনার বাইরে। 

মৃত ব্যাক্তিদের রাজত্ব এখান থেকেই শুরু
catacomb in paris 


হাজার হাজার কংকাল গুলোর প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম ও পরিচয় ছিল। এখন সবাই কঙ্কাল। এখানে ধনী-গরিব পাশাপাশি। জীবনের সুদীর্ঘ যাত্রা শেষে এখানে এসে যোগ দিয়েছেন। জাত-ধর্মের বৈরিতা নেই, প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, কুটিল স্বার্থপরতার অসুস্থ প্রতিযোগিতা নেই। এখানে সবাই সমান, সর্বোপরি চায় তারা সবাই এখন অনন্তকালের অতল গহ্বরে বাস করুক। 

প্রতিবছর সারা বিশ্ব থেকে মানুষ আসে পাতালপুরীর এই মৃত মানুষ দেখতে প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটক নগরী দেখতে আসেন। প্রবেশমূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য 29 ইউরো। আর চার থেকে সতের বছর বয়সীদের জন্য 5 ইউরো। একটু বেশিই খরচ করলে আপনাকে একটি যান্ত্রিক অডিও গাইড পাবেন। তবে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে এই প্রবেশ ফি কমানোর ব্যবস্থা রয়েছে। ভিড় এড়াতে আগে থেকে অনলাইনে টিকিট বুক করুন। এই পাতালপুরি সকাল ১০টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। 

সোমবার এবং কিছু ছুটির দিনে বন্ধ। প্যারিসের যেকোন স্থান থেকে হাজার বছরের ইতিহাসের সাথে, এখনও উজ্জ্বল ফরাসিদের এই প্যারি। এই শহরের উপরে 2 মিলিয়ন জীবিত মানুষের আবাস এবং এর মাটির নীচে 6 মিলিয়ন পক্ষান্তরে 7 মিলিয়ন প্রাচীন জীবিত মানুষের কঙ্কাল রয়েছে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ